Magic Lanthon

               

ভাব-ভাষান্তর : রুবেল পারভেজ ও আহমেদ মাসুম

প্রকাশিত ২৪ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

দ্বিতীয় ও শেষ কিস্তি

জনপ্রিয় চলচ্চিত্র

ভাব-ভাষান্তর : রুবেল পারভেজ ও আহমেদ মাসুম


ভারতীয় দর্শকরা এই ধরনের চলচ্চিত্র দেখতে অভ্যস্ত এবং এতেই তারা সবচেয়ে বেশি স্বস্তি বোধ করে। মনস্তত্ত্ববিদ সুধীর কাকার বলেন, হিন্দি চলচ্চিত্র সমন্বিত অলীক কল্পনাকে উপস্থাপন করে। এটা দিবাস্বপ্ন দেখায়, অবচেতন মনের নানা বিষয় ও সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষের লুক্কায়িত কামনা-বাসনাকে তুলে ধরে। তবে তা কোনো বিষয়ের অতোটা গভীরে যায় না। কেননা এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রযোজক ও নির্মাতারা অঢেল টাকা কামানোকেই তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য হিসেবে মনে করে। যে দিবাস্বপ্ন ব্যক্তির মধ্যে কাজ করে সেটি তার মধ্যে কোনো ভূমিকা রাখে না। তবে দর্শকরা যেসব উদ্বিগ্নতার কথা বলে, সেগুলোর প্রতি তাদের (প্রযোজক-নির্মাতা) অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে। আর যদি তারা এটি না করে, তাহলে হিন্দি চলচ্চিত্রের মান ও ক্ষেত্র ভীষণভাবে সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়বে।

অন্যান্য বিষয়ে দর্শক যেসব অতি অলীক কল্পনায় অবস্থান করে, একইভাবে হিন্দি চলচ্চিত্রও দর্শকের যেকোনো ইচ্ছার বাস্তবায়ন, যেকোনো মূল্যে প্রতিপক্ষকে কাহিল করা, শত্রুকে ধ্বংস করাএমন সব চিন্তার গুরুত্ব দেয়। রূপকথার মতোই এসব চলচ্চিত্রে গৎবাঁধা গল্পকে সুন্দরভাবে বার বার তুলে ধরা হয়, যা কেবল বাচ্চাদেরই আনন্দ দিতে সক্ষম।

তবে যৌক্তিকতার দিক থেকে হিন্দি চলচ্চিত্র অবাস্তব মনে হলেও কিছু ক্ষেত্রে তারা সত্যও তুলে ধরে। এসব চলচ্চিত্র বহির্জগৎ সম্পর্কে একটি ভঙ্গুর চিত্রকল্প নির্মাণ করে, যা আসলে দর্শকের বাস্তব জীবনে বেশিই অপ্রাসঙ্গিক। তা সত্ত্বেও হিন্দি চলচ্চিত্র সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা পূরণের বিষয়গুলোকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এমন নিখুঁতভাবে তুলে ধরে, যেনো দর্শক তা দেখেই বিশ্বাস করে।

আকাঙ্ক্ষা ও উদ্ভট কল্পনাদুইটি বিষয় আসলে অনমনীয়ভাবে সম্পর্কিত। উদ্ভট কল্পনা হলো আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ। এটি আকাঙ্ক্ষায় উৎসারিত কল্পনার জগৎ। হিন্দি চলচ্চিত্রে সমন্বিত অলীক কল্পনা ও ভারতীয় সংস্কৃতির মধ্যকার সম্পর্ক খুবই জটিল। যদিও হিন্দি চলচ্চিত্র নিজেই একটি সাংস্কৃতিক পণ্য। ফলে নজিরবিহীনভাবে হিন্দি চলচ্চিত্র একটি জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

জনপ্রিয় চলচ্চিত্র যে মূল্যবোধ তুলে ধরে, সেগুলোই দৃক যোগাযোগের বাকি সব ধরনকে নির্ধারণ করে; যেমন : ক্যালেন্ডারের ছবি, ম্যাগাজিনের চিত্র, বাড়ির সাজসজ্জা ও স্থাপত্য, এমনকি প্রথাগত প্রতিমা নির্মাণ এবং প্রার্থনার বিষয়বস্তুও ওই সব চলচ্চিত্র থেকে নেওয়া হয়। এছাড়া চলচ্চিত্রের তারকাদের মধ্যে দর্শক তাদের দেব-দেবীকে খুঁজে ফিরে। ভারতের বেশিরভাগ শহরেই মোটা দাগে যেসব গান চলে তার বেশিরভাগই এই চলচ্চিত্রের গান; অধিকাংশ জনপ্রিয় গানই চলচ্চিত্রের গানের অনুকরণে লেখা; জনপ্রিয় নাটকগুলোও চলচ্চিত্রকে নকল করে তৈরি। এছাড়া অধিকাংশ পাবলিক অনুষ্ঠানে যে ধ্রুপদী নৃত্য পরিবেশন করা হয়, তাতেও চলচ্চিত্রের নাচের যে ঢঙ, তার ছায়া আছে।

অলীক কল্পনা ও মোহাবিষ্ট করে হিন্দি চলচ্চিত্র ভারতে পারিবারিক সম্পর্ক ও দৈনন্দিন জীবনে সৃষ্ট চাপকে সাময়িকভাবে দমন করে রাখে। এখানকার অধিকাংশ চলচ্চিত্রে প্রাচীন পৌরাণিক কাহিনির কোনো না কোনো ছাপ থাকে। এক কথায়, নির্দিষ্ট কিছু পুরনো ও জনপ্রিয় পৌরাণিক কাহিনির আধুনিক সংস্করণ হলো হিন্দি চলচ্চিত্র। পৌরাণিক সব গল্প থেকে এই ধরনের চলচ্চিত্র কাহিনি তৈরি করতে জানে (যেমন, জয় সন্তোষি মা)। একই সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বগুলো সমাধানের পথও বাতলে দেয়।

ঔপনিবেশিক সময় থেকেই ভারতের অধিকাংশ চলচ্চিত্রে প্রথাগত সংস্কৃতিকে পাশ্চাত্যের মুখোমুখি দাঁড় করানোর একটি প্রবণতা ছিলো। পাশ্চাত্যকরণকে উপনিবেশবাদের অংশ হিসেবে দেখা হতো। ভারতীয় পারিবারিক-সামাজিক ঐতিহ্যের কাছে পাশ্চাত্য মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি হুমকি হিসেবে বিবেচিত হয়। এ কারণে খলনায়ককে পাশ্চাত্য পোশাক পরানো হতো, ধূমপানরত নারীকে খলনায়িকা বা সহচরী হিসেবে দেখানো হতো। নায়কের বিপরীতে খলনায়কের যে মূল্যবোধ দেখানো হতো, সেখানে স্পষ্ট একটি বিভাজন থাকতো। যেমন : খলনায়ক হবে পাশ্চাত্য মনোভঙ্গির। আর এ কারণেই সে হতো নৈতিকতাবর্জিত ও ন্যায়ভ্রষ্ট। এর বিপরীতে নায়ককে ভারতীয় ন্যায়নিষ্ঠ সংস্কৃতির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করা হতো। যেখানে ভারতীয় ঐতিহ্যকে দেখা হতো স্বাধীন, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের এক ভাণ্ডার হিসেবে।

গত ২০ বছরে দ্রুত শিল্পায়ন ও অধিক হারে নগরায়ণের সঙ্গে সঙ্গে পাশ্চাত্য ও ভারতীয় ঐতিহ্যের সম্পর্ক যেনো জটিল ও দ্ব্যর্থক হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে ভাববাদী আদর্শকে ধারণ করে সাধারণ জীবনযাপনের যে প্রথাগত ভারতীয় মূল্যবোধ ছিলো, তাও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ফলে চাপের মুখে পড়েছে। শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান (প্রায় নয়শো মিলিয়নের মধ্যে বর্তমানে দুইশো মিলিয়নই এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি) একধরনের আকাশ-পাতাল পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে। বস্তুবাদী হয়ে ওঠাই এখন সবার কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য। নগরায়ণ যৌথ পরিবারের ভাঙনকে ত্বরান্বিত করেছে। আগে যেখানে পরিবারকে ভারতীয় সমাজের প্রাথমিক একক হিসেবে দেখা হতো, এখন সেই অবস্থার পরিবর্তে শুধু ব্যক্তিকেই সমাজের মৌলিক একক হিসেবে দেখা হয়। জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্র সমাজের এই পরিবর্তনকে তুলে ধরছে।

যাহোক, এই তুলে ধরাটাকে অনেকের কাছে বিকৃত মনে হতে পারে। আর গত ২০ বছরে চলচ্চিত্রের এই জটিলতাকে ঘিরে গড়ে ওঠা দর্শক-মনোভাবেরও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পরিবর্তন ঘটেছে। আবার শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ক্রমবর্ধমানভাবে চলচ্চিত্র থেকে টেলিভিশনের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। এদিকে শ্রমিকশ্রেণি, শহুরে খেটেখাওয়া মানুষ এবং ১৩১৯ বছরের ছেলেমেয়েরা চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ দর্শক হয়ে উঠেছে। নগরের তীব্র বেকারত্ব ও শহরগুলোতে বাড়তে থাকা প্রান্তিক মানুষের ঢল চলচ্চিত্রের সাধারণ দর্শকদের একটি নিম্নবর্গীয়-সর্বহারা চরিত্র দিয়েছে। যেসব দর্শক প্রেক্ষাগৃহে যায়, তাদের কথা চিন্তা করে কঠোর সেন্সরশিপের জায়গা থেকে সরে আসার দাবি উঠছে ইদানীং। তবে এটি করতে গিয়ে নানাধরনের চাপের মুখেও পড়তে হয়েছে। বিশেষ করে টেলিভিশনের কারণে চলচ্চিত্র কমপক্ষে তার ৩০ শতাংশ বাজার হারিয়েছে। তাছাড়া ভিডিও পাইরেসিও চলচ্চিত্রের আয় কমিয়ে দেওয়ার অন্যতম কারণ।

অতীতে ভারতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে যেসব উৎস থেকে অর্থ আসতো, তার পুরোটাই চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলো। পরিবেশক ও প্রদর্শকরাও চলচ্চিত্র-নির্মাণে সহায়তা করতো, এমনকি ব্যবসায়িক ঝুঁকিগুলোও ইন্ডাস্ট্রির সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নিতো। বর্তমানে সে ব্যবস্থাগুলো আর নেই। আসলে ভারতে চলচ্চিত্র কখনোই সরকারিভাবে শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি) হিসেবে (বর্তমানে চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে) বিবেচিত হয়নি। অথচ চলচ্চিত্র-নির্মাণের জন্য এই ইন্ডাস্ট্রি সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থের ব্যবস্থা করতে পারতো। বর্তমানে যেসব উৎস চলচ্চিত্র-নির্মাণের জন্য অর্থায়ন করে, সেগুলোর সঙ্গে মূলত চলচ্চিত্রের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। এই অর্থের সুদের হারও অনেক বেশি। যে কারণে আজ চলচ্চিত্র-নির্মাণের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে।

বর্তমানে বক্স অফিসে ব্যর্থতার হার বেশি হওয়ায় চলচ্চিত্র-নির্মাণ আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তাপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ কারণে এখন দর্শক ধরার একটি বেপরোয়া প্রতিযোগিতায় সবাই মুখিয়ে থাকে। বিভিন্ন কৌশলে তারা দর্শকদের বাগে আনার চেষ্টা করে। আর সে কারণেই আগের নির্মিত সফল ভারতীয় বা হলিউডের চলচ্চিত্রকে শিল্পহীনভাবে অনুকরণ করতে দেখা যায়। আর সঙ্গে পাশ্চাত্য রক ও পপ সঙ্গীতের অনুকরণ করাটা তো শুরুই হয়ে গেছে। আবার এমনও হয়, দর্শকের মনোযোগ টানতে প্রচুর সংবেদনশীল দৃশ্য ব্যবহার করা হয়। যেটি আসলে বর্তমানের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোকে আরো বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল করে তুলেছে; যার বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে যৌনতা ও সহিংসতা। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই, প্রথাগত ভারতীয় চলচ্চিত্রের আঙ্গিকে কম-বেশি শাস্ত্রীয় আচারের ব্যবহার দেখা যায়। সামাজিক নৈতিকতায় সাধারণভাবে চলে আসা কিছু আদর্শিক উপাদান ছাড়া এই সব চলচ্চিত্রের সামাজিক প্রভাব একেবারেই অকল্পনীয়।

তবে দুঃখের কথা হলো, ভারতীয় চলচ্চিত্র এখন পর্যন্ত আলাদা কোনো ধারা তৈরি করতে পারেনি। একসময় এই চলচ্চিত্রে পৌরাণিক, সামাজিক ও পারিবারিকসহ নানা ধরনের প্রেক্ষাপট ছিলো। কিন্তু এখন শুধু একটি ধারাই চলছেপারিবারিক প্রেক্ষাপটে প্রতিহিংসাপরায়ণতা। বর্তমানের অধিকাংশ চলচ্চিত্রই এই ধরনের। এসব চলচ্চিত্রে তারা এমন এক ধারণা জিইয়ে রাখে যে, প্রতিশোধ নিতে পারাই হলো ন্যায়বিচার পাওয়ার একমাত্র ও শেষ উপায়। যথাযথ যুক্তি দিয়ে তারা এই পরিস্থিতিকে তুলেও ধরে।

স্বাধীনতার সময় থেকে ভারতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিরাট পরিবর্তন ঘটেছে, তা মূলত আইন ও বিচার কার্যক্রমকে চাপের মুখে ফেলে দিয়েছে। শহরের অধিকাংশ জনগণের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা কাজ করে যে, সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে এই আইন যথাযথ ভূমিকা পালন করে না। তাই আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা এখানকার মানুষের অনেক বেশি। সম্প্রতি ভারতীয় সমাজে চলচ্চিত্রের প্রভাব সম্পর্কে যে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে এটিও অন্যতম একটি কারণ। উদ্বিগ্ন হওয়ার দ্বিতীয় কারণটি হলো, চলচ্চিত্র সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গি বৈধকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুধু তাই নয়, সভ্য সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় বলে বিবেচিত এমন সব কাঠামো ভাঙতেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

জনগণের আচার-আচরণ বৈধকরণে চলচ্চিত্র যে ভূমিকা রাখে তা সবারই জানা। তাছাড়া সবাই এও জানে যে, বিদ্যমান সামাজিক মনোভাব ও মতামত পরিবর্তন ও মজবুত করতে এই মাধ্যম সক্রিয় ভূমিকা রাখে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জনপ্রিয় ধারার ভারতীয় চলচ্চিত্রে চরিত্রের বিন্যাসের ব্যাপারে একটি সূক্ষ্ম পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এখন আর খারাপ সত্তা থেকে ভালো সত্তাকে আলাদা করে দেখা, অথবা নায়ক ও খলনায়ক নির্মাণের ব্যাপারটি আগের মতো সরল না। খলনায়ক যে সবসময় খারাপই হবে, এমন নয়। এখন তাদের চরিত্রে একধরনের ভালোত্বের ছাপ তুলে ধরা হয়। কয়েক মাস আগে ডর নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। বক্স অফিস হিট করা ওই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে, খলনায়ক নায়িকার প্রেমে পাগল। খোলাখুলিভাবে সে অবশ্য প্রেমে পড়ার কথাটি নায়িকাকে বলতে পারে না। ফলে নিজে নিঃশেষ না হওয়া পর্যন্ত সে ক্রমাগত মেয়েটি ও তার পরিবারের ওপর সহিংসতা চালায়। যদিও এই চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন অংশ আমেরিকান চলচ্চিত্র কেপ ফেয়ার থেকে হুবহু নকল করা।

বর্তমানে এমন অনেক হিন্দি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে, যেখানে খলনায়ককে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা হয়েছে। আর যেসব অভিনেতা এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তাদের অনেকেই এখন বড়ো বড়ো তারকা বনে গেছেন। এ রকম ঘটনা আগে দেখা যেতো না। নায়ক এখন সম্মানজনক একক চরিত্রে অভিনয় করলেও খলনায়ক তাকে ছাড়িয়ে গেছে। চলচ্চিত্রে খলনায়করা এখন জীবনযাপনে নানারকম সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আবির্ভূত হচ্ছে এবং কোনো রকম সামাজিক ও নৈতিক প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই মাথা উঁচু করে চলতে পারছে। এইভাবে আসলে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সবকিছু ভেঙে ফেলে খলনায়কের অবস্থানকে একধরনের আইনি বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। একই ধরনের অবস্থা অবশ্য ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও দেখা যায়।

ভারতীয় রাজনীতিতে গত দুই দশকে নানা বিপজ্জনক ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। ভোট ব্যাংক তৈরি করতে এখানকার নির্বাচনভিত্তিক রাজনীতি কখনো কখনো সম্প্রদায় ও জাতিপ্রথাকে কাজে লাগিয়েছে। আর অপরাধমূলক কার্যক্রম থেকে রাজনীতি এখনো পুরোপুরি মুক্ত নয়। একটু খুঁজলেই দেখা যায়, রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের মধ্যে একধরনের সুসম্পর্ক আছে। মূলত আইনের দুর্বলতার কারণে এসব বিষয় অহরহ ঘটছে। জনপ্রিয় কিছু ভারতীয় চলচ্চিত্র এই উদ্বিগ্নতাকে তুলেও ধরে, কিন্তু সেটি একেবারেই গতানুগতিক ধারায়। এখানে শুধু নায়ক ও খলনায়ক চরিত্রের রাজনৈতিক সমস্যা ও পটভূমির সমীকরণ ক্ষীণভাবে তুলে ধরা হয়। ভারতের দর্শকরা সাধারণত এ রকম চলচ্চিত্রের প্রতি সাড়াও দেয়।

ভারতে চলচ্চিত্র তারকারা একসময় সফল রাজনীতিবিদ হয়েছেনএমন প্রমাণ অনেক আছে। এদের মধ্যে তেলেগু চলচ্চিত্রের সফল তারকা এন টি রমা রায়ের কথা বলা যেতে পারে। তিনি চলচ্চিত্রে এক হিন্দু দেবতার চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। সেসময় তিনি সবার কাছে ভালোত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। যে কারণে তিনি তার নিজ এলাকা অন্ধ্র প্রদেশের আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন; এমনকি পরে তাকে এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও করা হয়েছিলো। আর এখন তিনি অন্ধ্র প্রদেশের প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা। তারও আগে তামিল চলচ্চিত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতা এম জি রামচন্দ্র সফল রাজনীতিবিদ হিসেবে তামিলনাড়ু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন। যিনি সাধারণত গরিব, দুস্থ ও শোষিতদের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেএমন চরিত্রে অভিনয় করতেন।

যাহোক, সমীকরণ যতো সহজ শোনাচ্ছে, আসলে তা অতোটা সহজ নয়। তামিলনাড়ু রাজ্যের জনগণ তার (রামচন্দ্র) চলচ্চিত্রকে একধরনের অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখতো। কারণ তার অভিনীত চলচ্চিত্রে হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা করার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের ভূমিকার বিরোধিতা করা হতো। এছাড়াও তামিলনাড়ুকে একটি স্বায়ত্বশাসিত রাজ্য করার একধরনের দাবিও রামচন্দ্র অভিনীত চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তামিল সমাজে জাতিপ্রথা ও ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাচীন সাংস্কৃতিক যে শাসন চলে আসছে, সেসবের বিরুদ্ধে তার চলচ্চিত্র একধরনের সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছিলো। এখানে একটি বিষয় নজরে আসে; তা হলো, যেসব চলচ্চিত্র এই এলাকায় জনপ্রিয় সেগুলো কিন্তু তাদের নিজস্ব ভাষাতেই নির্মিত। এই চলচ্চিত্রগুলোর আঙ্গিক অনেকটা জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রের মতো হলেও সেগুলোর প্রকাশ কিন্তু অনেক বেশি আঞ্চলিক। নিজেদেরকে আলোচনায় রাখার ক্ষেত্রে এই প্রভাবন ক্ষমতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ বলে ধরা যেতে পারে।

আমি সবসময়ই বিশ্বাস করতাম, ভারতের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের এই গতানুগতিক ধারার মধ্যে থেকে স্বতন্ত্র ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটানো আসলে খুবই কঠিন। তার পরও গণবিনোদনের প্রতি একধরনের দায়বোধ একটি মানসম্মত সংস্কৃতি নির্মাণে তাদেরকে (সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্রনির্মাতাদের) সবসময়ই চালিত করে। তবে প্রশ্ন, সমাজের ওপর প্রভাব রাখে এমন কতোগুলো শিল্পগুণসম্পন্ন জনপ্রিয় চলচ্চিত্র বছরে নির্মাণ হয়? শিল্পগুণসম্পন্ন চলচ্চিত্র মানবীয় বিষয়গুলোকে অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে তুলে ধরে এবং দর্শকের চলচ্চিত্রিকবোধের সীমানাকেও প্রসারিত করে। কিন্তু কখনো কখনো জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব শিল্পগুণসম্পন্ন চলচ্চিত্রেও পড়ে। নিজ স্বার্থ হাসিলে এটিই জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।

এই চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ও কুসংস্কারকে ত্বরান্বিত ও শক্তিশালী করতে কাজ করে। ভালো ও মন্দের সমীকরণ কমিয়ে ফেলার মাধ্যমে তারা সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলোকে একেবারেই আড়াল করে ফেলে। মূলত এই স্বার্থগত-সঞ্চালন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি উৎসাহী দর্শকশ্রেণি তৈরি করার মধ্যেই তাদের চূড়ান্ত সফলতা নিহিত। এখন প্রশ্ন, তাহলে সেন্সরশিপ কি ভিন্ন কিছু তৈরি করতে পেরেছে? আমি মনে করি, পারেনি।

তরুণ ও যারা খুব সহজেই প্রভাবিত হয়এমন দর্শকদের ওপর চলচ্চিত্রের বিরাট প্রভাব রয়েছে। একটি উপায়ের মধ্য দিয়েই কেবল এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে; তা হলো শিক্ষা, মানে শিক্ষার ব্যাপক বিস্তার। এক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার চাইতে চলচ্চিত্র বিষয়ক শিক্ষাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিদ্যালয়ে সাহিত্যপাঠকে যেমন বাধ্যতামূলক করা হয়, ঠিক তেমনি চলচ্চিত্রকেও বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। অনেকের কাছে অবশ্য এই প্রস্তাবকে যুক্তিহীন মনে হতে পারে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, চলচ্চিত্র বিষয়ক জ্ঞান ছাড়া দর্শকের অনুধাবন শক্তির প্রকৃত কোনো পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়।

একজন নির্মাতা হিসেবে সমাজ পরিবর্তনে চলচ্চিত্রকে অনুঘটক হিসেবে দেখতে আমি প্রচণ্ডভাবে আগ্রহী। এই ধারণাটি আমাকে আমার চলচ্চিত্র-নির্মাণ ও সম্প্রতি টেলিভিশনের জন্য করা কাজে প্রচুর উৎসাহ দেয়। আজ থেকে প্রায় ১৮ বছর আগে মন্থন নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করি আমি। যেটি নির্মাণে গুজরাট রাজ্যের প্রায় পাঁচ লক্ষ খেটে খাওয়া মানুষ অর্থ সাহায্য করেছিলো। এটি এমন একটি চলচ্চিত্র, যেখানে একটি গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের সমবায়ভিত্তিতে দুগ্ধখামার গড়ে তোলার প্রচেষ্টা এবং প্রথাগত সমাজে তাদের জেগে ওঠার গল্পকে তুলে ধরা হয়। চলচ্চিত্রটি ব্যাপকভাবে সফল হয় বক্স অফিসে। ফলে বিনোদনের পরিসর ছাড়িয়ে চলচ্চিত্রটি সত্যিই এক অনন্য জায়গায় যেতে সক্ষম হয়। তাছাড়া সারাদেশের কমপক্ষে ৫০ হাজার গ্রামে আলোচনা ও গঠনমূলক সমালোচনার জন্য ন্যাশনাল ডেয়ারি বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদ মন্থনকে ব্যবহার পর্যন্ত করে।

এই দুগ্ধখামারিরা একত্র হওয়ার কারণেই ভারত আজ বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দুগ্ধ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু চলচ্চিত্রটিতে এই সফলতার গল্পকে তুলে না ধরে বরং যে উদ্দীপনাগুলো কৃষকদের একত্র হতে মূল ভূমিকা পালন করেছিলো তা তুলে আনা হয়। চলচ্চিত্র যে সমাজ পরিবর্তনে কার্যকর অনুঘটক হতে পারে, এমন ভাবনা তৈরিতে এই বিষয়টি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। কিন্তু তা যে চলচ্চিত্রের গতানুগতিক নাটকীয়তার মধ্য দিয়েই হতে হবে, এমন নয়।

সবশেষে, ভারতে হলিউডি চলচ্চিত্রের প্রভাব সম্পর্কে একটু আলোকপাত করতে চাই। ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে হলিউডের চলচ্চিত্র চলছে। কিন্তু কোনো সময় তাদের বাজার ১০ শতাংশ অতিক্রম করেনি। তার একটি কারণ হলো, হলিউডের চলচ্চিত্র ভারতে সবসময় তাদের ভাষায় (ইংরেজি) দেখানো হতো। তাছাড়া অন্যান্য সাংস্কৃতিক কারণ তো অবশ্যই আছে। যাহোক, এখনো ভারতীয় চলচ্চিত্রশিল্পের ওপর হলিউডের প্রভাব অপরিমেয়। কেননা ভারতীয় চলচ্চিত্র সবসময়ই হলিউডকে নকল ও অনুসরণ করেছে। এমনকি হিন্দি চলচ্চিত্রে যে প্রতিহিংসাপরায়ণ কাহিনি বলা হয় সেটিও আমেরিকান চলচ্চিত্র থেকেই নেওয়া। ভারতের বাজারে গত দুই দশকে খুব কমসংখ্যক হলিউডি চলচ্চিত্রই মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে হলিউডের প্রচুর চলচ্চিত্র এখন ভারতের বাজারে আসছে। আগেকার হলিউডি চলচ্চিত্রের নীতিমালার বাইরে গিয়ে সম্প্রতি জুরাসিক পার্ক হিন্দি ভাষায় রূপান্তর করে বাজারে ছাড়া হয়। (হয়তো ঠিক এই কারণেই) এটি আগের সব বক্স অফিস রেকর্ড ভেঙে ফেলে।

মনে রাখতে হবে, এখন এমন একটি সময়, যখন চলচ্চিত্রকে বলা হচ্ছে সর্বজনীন যোদ্ধা। প্রতিটি চলচ্চিত্রই কোনো না কোনোভাবে একে অন্যকে অনুসরণ করে। ভারতে হলিউডি চলচ্চিত্রের সফলতার ক্ষেত্রে এখনো কোনো সাংস্কৃতিক বাধা আছে কি না, তা নিয়ে হয়তো খুব শীঘ্রই কোনো গবেষণা হবে। তবে সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো, ভারতে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে আগে যেভাবে হলিউডি চলচ্চিত্র থেকে উপাদান নেওয়া হতো, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেগুলোর উপযোগিতা হারিয়ে গেছে।

ইতালির বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ও চিন্তাবিদ উমবার্তো ইকোর একটি বক্তব্য দিয়ে আমি আজকের আলোচনা শেষ করছি। চলচ্চিত্রকে গণমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করে ইকো বলেছিলেন, শুরুর দিকে গণমাধ্যম কল্পনাকে আমাদের কাছে বাস্তব হিসেবে তুলে ধরতো। আর এখন ঠিক উল্টোভাবে বাস্তবকে কাল্পনিক হিসেবে আমাদের কাছে উপস্থাপন করছে। এর চেয়েও বড়ো বাস্তবতা হলো, দৈনন্দিন জীবনে আমরা যা কিছু করছি, সেগুলোকেই আবার নাটকীয়ভাবে টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হচ্ছে। তবে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো দার্শনিক মতামত প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত আমরা এভাবে চিন্তা করতে পারি যে, পৃথিবীতে আমরা সবাই আলাদা এবং সবকিছুর পাশাপাশি চলচ্চিত্র আমাদের সামনে ভালো ও খারাপদুটোকেই তুলে ধরে।

 

দায়স্বীকার : Popular Cinema শিরোনামে শ্যাম বেনেগাল-এর এই বক্তৃতাটি প্রবোধ মৈত্র সম্পাদিত 100 Years of Cinema(১৯৯৫) নামের গ্রন্থ থেকে নেওয়া। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে নন্দন (পশ্চিমবঙ্গ, ভারত)।

 

অনুবাদক : রুবেল পারভেজ ও আহমেদ মাসুম, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর ও  ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

rubelmcj@gmail.com

mdmasum540@yahoo.com

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন